মৃত ব্যক্তির জন্য আমাদের করণীয় : পাতা -০৭

0 66

পাতা -০৭

মৃত ব্যক্তির জন্য যে সব কাজ করা নাজায়েয ও বিদা’ত

- Advertisement -

ইতোপূর্বে ছহীহ্ হাদীছের ভিত্তিতে ‘মৃত ব্যক্তির জন্য জীবিতদের করণীয়সমূহ’ শিরোনামে যেসব করণীয় উপস্থাপন করা হয়েছে তা মৃতব্যক্তিকে দাফন করা পর্যন্ত জীবিতদের করণীয় এবং রাসূলুল্লাহ (ছ:)-এর সুন্নাত। এসব সুন্নাত ছাড়া কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর থেকে দাফন করা ও দাফন উত্তর যতসব কাজ বিভিন্ন এলাকা ও অঞ্চল ভিত্তিক কালক্রমে নতুন নতুন উদ্ভাবিত হয়েছে তা সবই বিদা’ত ও নাজায়েয। যেমন-
* মৃত ব্যক্তির জন্য মাগফিরাত কামনার নামে তাহলীল পড়ানো,
* কুরআন খতম পড়ানো, মৃত ব্যক্তির চারপাশে বসে কুরআন পাঠ করা,
* গোসলের জন্য গরম পানি দেয়ার জন্য পাক ঘরের চুলা বাদ দিয়ে বাইরে চুলা করে গরম পানি দেয়া,
* মৃত ব্যক্তিকে যেখানে গোসল দেয়া হয় সে স্থান ৪দিন কিংবা ৪০দিন পর্যন্ত বেড়া দিয়ে সংরক্ষণ করা এবং রাতের বেলায় সেখানে মোম, হ্যারিকেন বা বৈদ্যুতিক বাতি দিয়ে আলোকিত করে রাখা,
* কাফন পরানোর সময় নির্ধারিত পরিমাণের চাউল, বিস্কুট ও ফলের ব্যবস্থা করা এবং সেগুলো কবরস্থানে আগত ফকিরদের মাঝে বিলি করা,
* জানাযা নিয়ে যাওয়ার সময় ‘আল্লাহু রাব্বী, মুহাম্মদ নবী’ কিংবা ‘কলমা শাহাদত’ পাঠ করা,
* জানাযা কবরস্থানে নেয়ার সময় খাটিয়ার উপর আগর বাতি জ্বালানো এবং জানাযা যাত্রীদের উপর গোলাপজল ছিটানো,
* কবরস্থানে জানাযা নেয়ার সময় খাটিয়াকে ছাতা বা কোন আচ্ছাদন দিয়ে ছায়া দান করে নিয়ে যাওয়া,
* জানাযা নামায শেষে “এ মানুষটি কেমন ছিল” উপস্থিত সবাই “বেশ ভাল ছিল” একথা বলা,
* জানাযার নামাযের পূর্বে মৃতব্যক্তির স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য দেয়া,
* জানাযা পড়ানোর সময় ইমামে একখণ্ড সাদা কাপড় জায়নামায হিসেবে ব্যবহার করা- যা মূলত কাপনের কাপড়ের অংশ বিশেষ,
* জানাযার নামায পড়ার পর পুনঃরায় খাটিয়ার সামনে দু’আ করা, ঐ সময় ক্বিয়াম করা, জ্বালাত ও সালাম পেশ করা,
* জানাযার নামাযের পর মৃত ব্যক্তিকে শেষ বারের মত দেখার জন্য মুখের কাফন খোলা,
* কাফনের উপর যে কোন রকমের দু’আ লিখে দেয়া কিংবা দু’আ লিখা কাপড়খণ্ড কাফনের সাথে লাগিয়ে দেয়া,
* কোন কাপড়খণ্ডের উপর কলমা লিখে ঐ কাপড় খণ্ড কবরের ভিতর মৃতের ডান পাশে মুখ বরাবর কবরের দেয়ালে টাঙ্গিয়ে দেয়া,
* কবরের উপর পুষ্পস্তবক অর্পণ করা,
* দাফন করার সময় প্রথম তিন অঞ্জলি মাঠি দেয়ার ক্ষেত্রে ‘মিনহা খালাকুনাকুম ওয়া মিনহা …….’ কুরআনের এ আয়াত পাঠ করা,
* দাফনের পর দু’আ করার পূর্বে একবার সূরা ফাতিহা, তিনবার সূরা ইখলাছ, একবার সূরা ফালাক্ব ও একবার সূরা না-স এভাবে কুরআন মজীদ থেকে কোন সূরা বা আয়াত পাঠ করা,
* দাফন ও দু’আ শেষে সবাই চলে আসার পর একজন বসে কবর তলক্বীন করা,
* কবর পাকা করা, তাতে মৃত ব্যক্তির নাম ফলক করা,
* কবরের উপর ঘর তৈরি করা বা মাযার নির্মাণ করা,
* মৃত্যুর পর চারদিন পর্যন্ত কিংবা চল্লিশ দিন পর্যন্ত বিভিন্ন ফাতিহা পড়ানো,
* মৃত ব্যক্তির বাড়ীতে তিন দিন পর্যন্ত আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক পালাক্রমে খানা পাঠানো,
* মৃত্যুর পর চারদিন বা চল্লিশ দিন পর্যন্ত মোল্লা-মৌলভী দিয়ে প্যান্ডেল টাঙিয়ে কবর পাহারা দেওয়া,
* মৃত ব্যক্তির বাড়িতে তিন দিন পর্যন্ত চুলা না জ্বালানো ও খানা পাক না করা,
* মৃত ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিত্ব কিংবা জাতীয় নেতা-নেত্রী হলে অথবা সামরিক ব্যক্তি হলে দাফনের সময় তোপধ্বনি করা ও যুদ্ধের বাজনা বাজানো,
* জানাযার নামাযের সময় জুতা-সেন্ডেল পাক থাকলেও খুলে রাখা (সুন্নাত হল জুতা-সেন্ডেল পাক থাকলে না খুলে নামায পড়া),
* জানাযার নামাযে প্রথম তাকবীরের পর ‘ছানা’ পড়া, (সুন্নাত হল ‘ছানা’ না পড়ে সূরা ফাতিহা পড়া),
* নেককার বা বুযুর্গ ব্যক্তি হিসেবে কোন কবরে বিছানা-বালিশ দেয়া,
* মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখার সময় আজান দেয়া,
* মৃত্যুর পূর্বেই কবর খনন করে রাখা,
* মৃত ব্যক্তির কাযা নামায থাকলে কিংবা মৃত ব্যক্তি বেনামাযী হলে তার নামাযের আর্থিক কাফফারা হিসাব করে কাফফারা আদায় করা এবং এ মৃত ব্যক্তি গরীব লোক হলে কাফফারার পরিবর্তে একটি কুরআন মজীদ কাউকে হাদিয়া প্রদান করে কাফফারা এসক্বাত্ব (দূরীভূত করা) করা ইত্যাদি ইত্যাদি।

উল্লেখিত কাজসমূহ বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিবিশেষ কর্তৃক সম্পূর্ণ নব উদ্ভাবিত। এসব কাজের কোন শর’য়ী ভিত্তি নেই। অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল (ছঃ) যেমন এসব কাজ করেছেন বলে কোন প্রমাণ নেই, তেমনি ছাহাবা কিরামগণের পক্ষ থেকেও এসব কাজের কোন ভিত্তি নেই। উল্লেখ্য, যে কাজ আল্লাহর রাসূল (ছঃ) কিংবা দ্বাহাবা কিরামগণের পক্ষ থেকেও পাওয়া যাবে না তা কোন শর’য়ী কাজ বলে গণ্য হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন:
مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدُّ .
যে কেউ এমন কোন কাজ করল যে কাজ করার জন্য আমাদের কোন হুকুম নেই তা প্রত্যাখ্যাত অথ্যাৎ অগ্রহণযোগ্য। (মুসলিম হা: নং-৪৩৪৪)
তিনি আরো বলেছেন:
مَنْ أَحَدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَالَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدُّ
যে ব্যক্তি আমাদের শরীয়তে নতুন কিছু প্রবর্তন করবে তা প্রত্যাখ্যাত বা অগ্রহণযোগ্য। (বুখারী হা: নং ২৫০১, মুসলিম হা: নং ৪৩৪৩)
তিনি (সাপ্তাহিক) জুমার খুত্ববায় বলতেন:
أَمَّا بَعْدُ فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ الله وَخَيْرُ الْهُدَى هُدًى مُحَمَّد وَشَرُّ الْأَمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ
অতঃপর সর্বোত্তম বাণী হলো আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম হেদায়াত হলো মুহাম্মদের হেদায়াত। নিকৃষ্ট কাজসমূহ হলো বিদা’ত (নব উদ্ভাবিত)। আর সকল বিদা’তই হলো গোমরাহী অর্থাৎ পথভ্রষ্টতা। (মুসলিম হা: নং ১৮৮৩)
নাসায়ীর বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে:
وَكُلُّ ضَلَالَةِ فِي النَّارِ
আর প্রত্যেক পথভ্রষ্টকারী হবে জাহান্নামী। (হা: নং ১৫৭৮)
সুতরাং ইতোপূর্বে মৃত ব্যক্তির জন্য যেসব কাজ নাজায়েয ও বিদা’ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে তা রাসূলুল্লাহ (দ্বঃ)-এর এই ছুহীহ হাদীছ অনুযায়ী সত্যিই নাজায়েয এবং বিদা’ত। আর বিদা’ত হলো- গোমরাহী যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
মৃত ব্যক্তির জন্য যেসব কাজ করা নাজায়েয ও বিদা’ত তন্মধ্যে মৃত ব্যক্তির চারপাশে বসে কুরআন পাঠ করা, তার জন্য কুরআন খতম পড়া কিংবা কুরআন খতম পড়ানো এবং কবরের পাশে কুরআন পড়ার মাধ্যমে চারদিন পর্যন্ত কবর পাহারা দেয়া বিদা’ত ও নাজায়েয তো বটেই, অধিকন্তু তা কুরআন মজীদের অপব্যবহার এবং কুরআন অবমাননারও শামিল। কেননা, কুরআন মজীদ কোন মৃত ব্যক্তির জন্য নাযিল হয় নি। বরং কুরআন মজীদ নাযিল হয়েছে জীবিতদের জন্য। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
إنْ هُوَ إِلا ذِكْرٌ وَقُرْآنٌ مُبِينٌ لِيُنْذِرَ مَنْ كَانَ حَيًّا وَيَحِقَّ الْقَوْلُ عَلَى الكافرين
এ তো এক উপদেশ মাত্র এবং সুস্পষ্ট কুরআন; যেন সে সতর্ক করতে পারে জীবিতদেরকে এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে শাস্তির কথা যেন সত্য প্রমাণিত করতে পারে। (সূরা ইয়াসীন ৬৯-৭০)

এ ছাড়া মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন পড়া হলে যদি কোন ফায়দা বা কল্যাণ হতো, তাহলে আল্লাহর রাসূল (ছঃ) তাঁর জীবদ্দশায় কোন মৃত ব্যক্তির জন্য কোন কুরআন পড়লেন না কেন কিংবা পড়ার জন্য কাউকে বললেন না কেন অথবা মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন পড়া হলে যে ফযীলত আছে তা বর্ণনা করলেন না কেন? অথচ মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন পড়া হলে কোন ফায়দা বা কল্যাণ হবে কিনা সে ব্যাপারে সর্বাধিক জ্ঞাত হবার কথা রাসূল (ছঃ)-এরই। শুধু তাই নয়, জ্বাহাবা কিরামের দীর্ঘ ইতিহাসেও কেউ কোন মৃত ব্যক্তির জন্য কোন কুরআন পড়েছেন বলো কোন প্রমাণ নেই। এ কথার জবাবে যারা বলে মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন পড়া হলে কিংবা পড়ানো হলে তাতে অবশ্যই ফায়দা আছে, যদিও আল্লাহর রাসূল (ছঃ) কিংবা দ্বাহাবা কিরামগণ তা করেন নি। তাহলে একথার অর্থ দ্বারা এটাই বুঝা যায় যে, মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন পড়া হলে কিংবা পড়ানো হলে তাতে যে ফায়দা আছে হয় তা আল্লাহর রাসূল (ছঃ) জানতেন না। (না’উজুবিল্লাহি মিন জালিক), নতুবা রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর যুগে দীনের সব আমল পূর্ণতা লাভ করে নি। তাই এখন তা পূর্ণাঙ্গ করার দায়িত্ব আমাদেররই। অথচ ইসলাম একটি পরিপূর্ণ দীন একথা রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর বিদায় হজ্জের দিনই আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেন:
اليومَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَنْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الاسلام دينا
“আজ তোমাদের দীনকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি পূর্ণ করে দিলাম। আর তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দীন হিসেবে মনোনিত করলাম।” (সূরা মাইদা-৮)
রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর উপর নাযিলকৃত এই পূর্ণাঙ্গ দীন তিনি উম্মতের কাছে পরিপূর্ণভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। ঐ বিদায় হজ্জের দিনই তিনি উপস্থিত জনতাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন:
أَلَا هَلْ بَلَغْتُ قَالُوا نَعَمْ قَالَ اللَّهُمَّ اشْهَدُ فَلْيُبَلِّغَ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ
“তোমরা লক্ষ্য করো, আমি কি (আমার উপর প্রদত্ত সবকিছু) তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি? উপস্থিত সবাই বললো, হ্যাঁ (পৌঁছে দিয়েছেন)। এসময় তিনি বললেন, হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাকো। আর তোমরা যারা উপস্থিত আছো তাদের উচিত অনুপস্থিত তথা অনাগত উম্মতদের কাছে এ বাণী পৌঁছিয়ে দেয়া।” (বুখারী হা: নং ১৬২১)
সুতরাং আল্লাহর রাসূল (ছঃ) জীবিতদের কল্যাণের ন্যায় মৃতদের আত্মার শান্তির জন্য যেসব আমল করেছেন কিংবা করতে বলেছেন তা-ই উম্মতের জন্য যথেষ্ট। এ আক্বীদা এবং বিশ্বাস থাকতে হবে প্রতিটি মুসলমানের। তাঁর প্রদর্শিত পথ ব্যতীত অন্য সব কিছুই গোমরাহী এবং ভ্রান্ত। তিনি বলেছেন:
وَإِيَّاكُمْ وَمُحدَثَاتِ الأمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضلالة
তোমরা (দীনী আমলের ব্যাপারে) নতুন নতুন কোন কিছু উদ্ভাবন করা থেকে দূরে থাকো। কেননা, (কোন আমলের ও ইবাদতের ব্যাপারে) প্রত্যেক নব উদ্ভাবিত কাজই হল বিদা’ত আর প্রত্যেক বিদা’তই হল গোমরাহী বা ভ্রান্ত। (আবু দাউদ হাঃ নং ৪৬০৭)

আগের পাতা: ০৬ | পরবর্তী পাতা: ০৮

- Advertisement -

Comments
Loading...