দুবাইয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশী তরুণীরা

- Advertisement -


ভালো বেতনে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়ার কথা বলে নাচের প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণীকে দুবাই পাঠানো হতো। সেখানে পৌঁছানোর পর তাদের কোনো টাকা-পয়সা দেওয়া হতো না। উল্টো শোষণ ও নিপীড়ন চালানো হতো। দেশটিতে এমন নির্মমতার শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের শত শত তরুণী। নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে অবশেষে অভিযোগ করেন তারা।

তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে মানব পাচার আইনে মামলা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মামলার পর ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার সোহাগ।

বর্তমানে ওই মামলা তদন্ত করছে সিআইডি। আগামীকাল ৭ মার্চ রোববার মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। মামলাটি তদন্তে তদারকি করছেন সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আক্তার হোসেন।

তিনি বলেন, ‘গুরুত্ব সহকারে মামলাটির তদন্ত চলছে। এ মামলায় নৃত্যশিল্পী ইভানসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চারজন দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। ঘটনার সঙ্গে অনেকে জড়িত। আমরা তাদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা করছি। শিগগির এই মামলার প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।’

মামলাটি তদন্ত করছেন সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক রেজাউল কবির খান। তিনি গত ১৪ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন।

সেখানে তিনি জানান, লালবাগ (ডিএমপি) থানায় ২০২০ সালের ২ জুলাই মামলাটি দায়েরের পর ওই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কাদের তদন্তভার গ্রহণ করেন। ২০২০ সালের ৮ জুলাই মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন সিআইডির এসআই কামরুজ্জামান।

প্রতিবেদনে রেজাউল কবির বলেন, মামলার এজাহারনামীয় আসামিসহ তদন্তে প্রাপ্ত সন্দেহজনক আসামিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করার জন্য অনুসন্ধান স্লিপ পাঠান এসআই কামরুজ্জামান। এ জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করা হয়। এসআই কামরুজ্জামান পুলিশ পরিদর্শক পদে বদলি হওয়ায় মামলাটি তদন্তের ভার তার (রেজাউল) ওপর ন্যস্ত হয়।

২০২০ সালের ২ নভেম্বর মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন তিনি এবং মামলার এজাহারনামীয় পলাতক আসামিসহ তদন্তে প্রাপ্ত সন্দেহজনক আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেন।

ওই মামলার আসামিরা হলেন আলামিন হোসেন ওরফে ডায়মন্ড (২৬), স্বপন হোসেন (২৮), আজম খান (৪৫), নাজিম (৩৬), এরশাদ ও নির্মল চন্দ্র দাস (এজেন্ট), আলমগীর, আমান (এজেন্ট) ও শুভ (এজেন্ট)। মামলার পর আলামিন হোসেন ওরফে ডায়মন্ড, আজম খান, নির্মল দাস, আনোয়ার হোসেন, ইয়ামিন এবং ইভান শাহরিয়ার সোহাগকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। গ্রেপ্তারের পর তাদের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে নির্মল, আজম, আলামিন ও ইয়ামিন আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন।

রেজাউল কবির বলেন, এটি একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় মামলা। তাই মামলাটির সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এজাহারনামীয় ও তদন্তে প্রাপ্ত পলাতক আসামিদের শনাক্তকরণ, নাম-ঠিকানা সংগ্রহ, গ্রেপ্তার এবং আসামিদের সঙ্গে পাচার চক্রে জড়িত মূলহোতা ও আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী দলের সদস্যদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা হচ্ছে।

এ ছাড়া মামলার সঙ্গে জড়িত আসামিদের সংশ্লিষ্টতা নির্ণয়ের জন্য এবং মামলাসংক্রান্ত জিজ্ঞাসাবাদ করে অপরাপর আসামিদের শনাক্ত ও চিহ্নিতকরণসহ গ্রেপ্তারপূর্বক আদালতে সোপর্দ করে শিগগির আলোচ্য মামলার তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইভান শাহরিয়ার সোহাগ আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের সক্রিয় সদস্য। নাচের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কথা বলে তরুণীদের ‘আর্টিস্ট’ হিসেবে দেখিয়ে বিদেশে পাচার করতেন তিনি। ইভানদের মানব পাচারের জাল বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। তিনি ও তার চক্রে লোকেরা ভুক্তভোগীদের নাচ শিখিয়ে ভালো বেতনে বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবে রাজি হলে ভুক্তভোগীদের থাকা-খাওয়া নিশ্চিত করাসহ ক্লাবে নাচ-গান করার বিনিময়ে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন প্রদান করবেন বলে মৌখিক চুক্তি করেন তারা।

ভুক্তভোগীরা সরল বিশ্বাসে আসামিদের ওপর ভরসা করে দুবাইসহ অন্যান্য দেশে যেতে রাজি হন। আসামি আজম খান, তার ভাই নাজিম ও এরশাদের সহায়তায় ভুক্তভোগী ময়নার পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় কাজগপত্র প্রস্তুত করে দেন। তারপর ২০১৯ সালের মে মাসে ময়নাকে দুবাইয়ের শারজাহ নিয়ে যান। পরবর্তীকালে সেখানে নিয়ে ময়নাকে নিজেসহ বিভিন্ন লোক নিয়ে যৌন নির্যাতন চালান আজম খান। কিন্তু দুবাই গমনের পর আসামিরা ময়নাকে কোনো বেতন দেননি।

আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে নির্মল দাস, আলমগীর, আমান ও শুভসহ অজ্ঞাতনামা এজেন্টের সহায়তায় ভুক্তভোগী আলেয়া ও মনি আক্তারদের ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গার ডান্স ক্লাব থেকে প্রলোভন দেখিয়ে বেছে নেন। এভাবে বহু বাংলাদেশি নারীর সরলতার সুযোগ নিয়ে আসামিরা দুবাইসহ অন্যান্য দেশে পাচার করেন এবং জোরপূর্বক আটক রেখে যৌন নির্যাতন চালান।

সরলতার সুযোগে বানানো হতো নির্মম শিকার : এ-সংক্রান্ত মামলার এজাহারে বলা হয়, বিবাদী আলামিন হোসেন একজন ডান্স প্রশিক্ষক। ময়নাকে ডায়মন্ডের কাছে নিয়ে আসেন তার পরিচিত মিরপুরের ভুক্তভোগী ফাতেমা। ময়নাকে ডায়মন্ড আশ্বস্ত করেন যে, ভালো বেতনে তাকে বিদেশে নাচের ব্যবস্থা করে দেবেন। ডায়মন্ডের কথায় ময়না আশ্বস্ত হলে ২০১৯ সালের ২ মে আরেক আসামি স্বপন হোসেনের কাছে নিয়ে আসা হয়।

স্বপন দুবাইয়ের ডান্স ক্লাব ফরচুন পার্ল হোটেল, ফরচুন গ্র্যান্ড সিটি টাওয়ারের মালিক বিবাদী আজমের কাছে নিয়ে যান ময়নাকে। ময়নার থাকা-খাওয়া নিশ্চিতকরণসহ ক্লাবে নাচ-গান করার বিনিময়ে প্রতি মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে মর্মে মৌখিক চুক্তি করেন আজম। ময়না সরল বিশ্বাসে তার ওপর ভরসা করে দুবাই যেতে রাজি হন।

আজমের ভাই আসামি নাজিম ও এরশাদের সহায়তায় ময়নার পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করা হয়। তার পর মে মাসে ময়নাকে দুবাইয়ের শারজাহ নিয়ে যান তারা। পরে আজম সেখানে নিয়ে ময়নাকে নিজেসহ বিভিন্ন লোক দিয়ে যৌন শোষণ ও নিপীড়ন করেন। কিন্তু দুবাই গমনের পর তারা ময়নাকে কোনো টাকা-পয়সা দেননি।

ঠিক একই কায়দায় আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে আসামি নির্মল দাস, আলমগীর, আমান ও শুভসহ অজ্ঞাতনামা এজেন্টদের সহায়তায় ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গার ডান্স ক্লাব থেকে প্রলোভন দেখিয়ে ভুক্তভোগী আলেয়া ও মনি আক্তারদের বেছে নেন এবং শিকার বানান।

এভাবে বহু বাংলাদেশি নারীর সরলতার সুযোগ নিয়ে দুবাইসহ অন্যান্য দেশে পাচার করেন এবং জোরপূর্বক আটক রেখে যৌন শোষণ ও নিপীড়ন করেন আসামিরা। তারা একটি সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য। দীর্ঘদিন ধরে অনুরূপভাবে বাংলাদশি তরুণীদের দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন তারা।

মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন

এ সম্পর্কিত পোস্ট:

ইস্টার সানডে উপলক্ষে বান্দরবান সেনা জোনের সৌজন্যমূলক কেক বিতরণ

ডেস্ক রিপোর্টঃ   ইস্টার সানডে উপলক্ষে বান্দরবান সেনা জোনের সৌজন্যমূলক কেক বিতরণ   খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ‘ইস্টার সানডে’ উপলক্ষে...

তিন পার্বত্য জেলায় পিসিসিপি’র বৈশাখী শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত

ডেস্ক রিপোর্টঃ তিন পার্বত্য জেলায় পিসিসিপি'র বৈশাখী শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ উদযাপনে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র...

বান্দরবানে সেনা জোনের উদ্যোগে সাংগ্রাইংপুয়ে উপলক্ষে আর্থিক অনুদান প্রদান

বান্দরবান প্রতিনিধিঃ   বান্দরবান সেনা জোনের উদ্যোগে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব সাংগ্রাইংপুয়ে উপলক্ষে গরীব ও দুস্থ...

সেনাবাহিনী কর্তৃক বৈসাবি উপলক্ষ্যে উপজাতীয়দের মাঝে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী প্রদান

বান্দরবান প্রতিনিধিঃ অদ্য ১২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখ বাংলা নববর্ষ ও স্টার সান্ডে সামনে রেখে প্রধান উৎসব 'বৈসাবি' উদযাপন উপলক্ষে...