মৃত ব্যক্তির জন্য আমাদের করণীয় : ইছালে ছওয়াবের নিয়ম

0 67

পাতা -০৮

মৃত ব্যক্তির জন্য ইছালে ছওয়াবের নিয়ম

ইছালে ছওয়াব অর্থ ছওয়াব পৌঁছানো। মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তির জন্য
আল্লাহ তা’আলার কাছে মাগফিরাত কামনা করে শরী’য়ত সম্মতভাবে যা কিছু করা হয় তার নামই হলো ইছালে ছওয়াব।
যেহেতু ইছালে ছওয়াবও দীনী আমলের একটি অঙ্গ সেহেতু এই আমলের ক্ষেত্রেও শরী’য়তের সঠিক দিক নির্দেশনা রয়েছে। শরী’য়তের দিক-নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিজের মনগড়া ও গতানুগতিক বা প্রচলিত নিয়মে যদি কেউ মৃত ব্যক্তির আত্মার মাগফিরাতের জন্য ইছালে ছওয়াবের আয়োজন করে তাহলে তা ইছালে ছওয়াব বলে গণ্য হবে না। শরী’য়ত সম্মত ইছালে ছওয়াবের নিয়ম হলো:

১. মৃত ব্যক্তির জন্য দু’আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করা

আল্লাহ তা’আলার শিক্ষামূলক এরশাদ:
وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلَا خَوَانِنَا الَّذِينَ سَبْقُونَ بالايمان
যারা তাদের (মৃতদের) পরে (দুনিয়ায়) এসেছে তারা বলে- “হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে ও আমাদের যে সকল ভাই পূর্বে ঈমানের সাথে অতীত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা কর।” (সূরা হাশর-১০)
এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা যে সকল মুমেন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন তাদের মাগফিরাতের জন্য দু’আ করতে শিক্ষা দিয়েছেন। অনুরূপভাবে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: প্রত্যেক মুমেন ব্যক্তি যেন তার মৃত ও জীবিত মা-বাপের জন্য এভাবে দু’আ করে:
رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيني صغيراً
হে প্রভু! এদের প্রতি এমনভাবে রহম কর, যেমন করে তারা স্নেহ-বাৎসল্যে বাল্যকালে আমাকে লালন-পালন করেছেন। (সূরা বনী ইসরাইল- ২৪) অনুরূপভাবে মৃত পিতা-মাতার সৎ সন্তান যদি তাদের জন্য দু’আ করে তাহলে
তার ফলও তারা পেয়ে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (ছ:) বলেছেন:
إذا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلَهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَ إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جارية أو علم يَنْفَعُ بِهِ أَوْ وَلَد صَالِحٍ يَدْعُولَهُ
মানুষ যখন মৃত্যু বরণ করে, তখন তার সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি কাজের ফল সে পেতে থাকে- (১) ছুদকায়ে জারিয়াহ্ (অর্থাৎ এমন দান যা থেকে মানুষ অব্যাহতভাবে উপকৃত হয়ে থাকে), (২) মানুষের উপকারে আসে এমন কোন জ্ঞান, (৩) সুসন্তান, যে তার জন্য দু’আ করে। (মুসলিম হা: নং ৪০৭৬)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবী কাতাদাহ্ তিনি তার পিতা হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (দ্বঃ) বলেছেন:
خَيْرُ مَا يُخَلَّفُ الرَّجُلُ مِنْ بَعْدِهِ ثَلث وَلَدٌ صَالِحٌ يَدْعُ لَهُ وَصَدْقَةٌ تَجْرى يَبْلُغُهُ أَجْرُهَا وَعَلمُ يُعْمَلُ بِهِ مِنْ بَعْدِه
কোন ব্যক্তি তার মৃত্যুর পরে যা রেখে যায় তার মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে তিনটি বস্তু; সুসন্তান যে তার পিতা-মাতার জন্য দু’আ করবে, এমন ছুদকায়ে জারিয়‍্যাহ্ যার ছওয়াব তার নিকট পৌঁছতে থাকবে এবং সেই জ্ঞান যার উপর তার মৃত্যুর পরেও আমল করা হবে। (ইবনে হিব্বান- ৮৪, ত্ববারানী)
এ ছাড়া কোন মুসলিম ব্যক্তি তার অগোচরে তার কোন ভাইয়ের জন্য দু’আ করলে তাও কবুল হয়। রাসূলুল্লাহ্ (ছ:) বলেছেন:
دَعْوَةُ الْمُسْلِمِ لأَخِيهِ بِظَهْرِ الْغَيْبِ مُسْتَجَابَةٌ عِنْدَ رَأْسِهِ مَلَكُ مُوَكَّلٌ كُلَّمَا دَعَا لأخيه قَالَ الْمَلَكُ الْمَوَكل به امنين ولك بمثل
মুসলিম ব্যক্তি তার অগোচরে থাকা (মুসলিম) ভাইয়ের জন্য দু’আ করলে তা গৃহীত হয়। দায়িত্ব প্রাপ্ত এক ফেরেশতা তার মাথার নিকটে থাকে। যখনই সে তার ভাইয়ের জন্য কল্যাণ কামনা করে দু’আ করে তখনই দায়িত্ব প্রাপ্ত সে ফেরেশতা বলেন: আমীন। তোমার জন্যও অনুরূপ (দু’আ কবুল হোক)। (আবু দাউদ- ১৫৩৪, আহমদ- ২১২০০)

২. মৃত ব্যক্তির জন্য দান-ছুদকা করা এবং জনকল্যাণমূলক কাজ করা

হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: “এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল (ছঃ) কে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার মা হঠাৎ মৃত্যু বরণ করেছেন, কোন রকমের উপদেশ দিয়ে যেতে পারেন নি। আমার মনে হয় যদি তিনি কথা বলতে পারতেন তাহলে তার জন্য দান-ছুদকা করার নির্দেশ দিতেন। এখন যদি আমি তার জন্য দান-ছুদকা করি তাহলে কি তিনি তার ছওয়াব পাবেন? রাসূলুল্লাহ (ছ:) বললেন: نعم হ্যাঁ। (বুখারী- হা: নং ১৬৩১, মুসলিম-৩৫৯১)
হযরত সা’দ বিন উবাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-কে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ্। আমার মা ইন্তিকাল করেছেন। কি ধরনের দান- ছুদকা তার জন্য উত্তম হবে? আল্লাহর রাসূল (ছঃ) বললেন, “পানির ব্যবস্থ কর”। সুতরাং হযরত সা’দ পানির একটি কূপ খনন করে তা তাঁর মায়ের নামে (জনসাধারণের জন্য) উৎসর্গ করে দিলেন। (আবু দাউদ হাঃ নং ১৬৮১) হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি নবী (ছ:)-এর নিকট এসে বললো, আমার আব্বা মারা গেছেন, তিনি ধন-সম্পদও রেখে গেছেন। কিন্তু তিনি অছিয়ত করে যান নি। সুতরাং এখন যদি তাঁর পক্ষ থেকে দান- খয়রাত করা হয়, তাহলে তা তাঁর (গুনাহর) কাফফারা হবে কিনা? (অর্থাৎ তিনি এর ছওয়াব পাবেন কিনা?) উত্তরে তিনি বললেন: نعم হ্যাঁ পাবে। (মুসলিম- হাঃ নং ৪০৭২)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার মা মৃত্যু বরণ করেছেন। তার জন্য আমি কোন দান-ছুদকা করলে কি তার কোন কল্যাণে আসবে? রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বললেন, نعم হ্যাঁ। সে বললো আমার একটি বাগান আছে। আপনাকে আমি সাক্ষী রেখে বলছি তার জন্য আমি তা দান করে দিলাম। (তিরমিজী- হা: নং ৬২১)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (দ্বঃ) বলেছেন:
إِنَّ مِمَّا يَلْحَقُ الْمُؤْمِنِ مِنْ عَمَلِهِ وَحَسْنَاتِهِ بَعْدَ مَوْتِهِ عِلْمًا عَلَّمَهُ وَنَشَرَهُ وَوَلَدٌ صَالِحًا تَرَكَهُ وَمُصْحَفًا وَرَبَّهُ أَوْ مَسْجِدًا بَنَاهُ أَوْ بَيْتًا لابْنِ السَّبِيلِ بَنَاهُ أَوْ نَهْرًا أَجْرَاهُ أَوْ صَدَقَةً أَخْرَجَهَا مِنْ مَالِهِ فِي صحته وحياته يَلْحَقُهُ مِنْ بعد موته
মুমেনের ইন্তিকালের পর তার যে সকল ভাল ও সৎকর্ম তার কাছে পৌঁছে তা হলো সেই জ্ঞান এবং শিক্ষা দিয়ে যায় যাওয়া প্রচার অব্যাহত থাকে। সৎ সন্তান রেখে যাওয়া, কুরআন শরীফের উত্তরসুরি করে যাওয়া, মসজিদ নির্মাণ করে যাওয়া, মুসাফিরখানা নির্মাণ করে যাওয়া, কোন খাল খনন করে প্রবহমান করে দেওয়া অথবা তার ধন-সম্পদ থেকে এমন কোন দান-ছুদকা করে যাওয়া যা দ্বারা মানুষেরা তার জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরও উপকার পেতে থাকে। (ইববে মাজাহ, হুহীহ ইবনে খুযাইমা ২৪৯০)

৩. মৃত ব্যক্তির কোন ফরয রোযার কাযা (বাকি) থাকলে তার পক্ষ থেকে তার ফিদিয়া আদায় করা

হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছ:) বলেছেন:
مَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ صِيَامٌ صَامَ عَنْهُ وَلِيُّهُ
কোন মৃত ব্যক্তির উপর কাযা রোযা থাকলে ঐ লোকের অভিভাবক তার পক্ষ থেকে তার রোযা আদায় করবে। (বুখারী হা: নং ১৮১২)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী (জ্বঃ)-এর কাছে এসে বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার মা মৃত্যু বরণ করেছেন। তাঁর এক মাসের রোযা কাযা আছে। আমি কি তাঁর পক্ষ থেকে তা আদায় করবো? নবী (ছঃ) বললেন:
نَعَمْ فَدَيْنُ اللَّهِ أَحَقُّ أَنْ يُقْضَى .
হ্যাঁ, আল্লাহর ঋণ পরিশোধিত হওয়ার হক বেশি। (বুখারী, হা: নং ১৮১৩)
মূলত অপরের পক্ষে রোযা আদায় করা মানে রোযার ফিদিয়া আদায় করা। রোযা রাখা নয়। তখন রোযা রাখার অর্থ ফিদিয়া আদায় করা।
হযরত আমরাহ বর্ণনা করেছেন:
أنَّ أُمَّهَا مَاتَتْ وَعَلَيْهَا مِنْ رَمْضَانَ فَقَالَتْ لعَائِشَةَ أقفضيهُ عَنْهَا ؟ قَالَتْ : لَا بَلْ تُصَدِّقِي عَنْهَا مَكَانَ كُلَّ يَوْمٍ نِصْفُ صَاعَ عَلَى كُلِّ مسكين
তার (আমরাহর) মা এমতাবস্থায় মারা গিয়েছেন যে তার উপর রমযানে কয়েকটি রোযা কাযা আছে। তাই সে আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি তার (মায়ের) পক্ষ থেকে (কাযা রোযা) আদায় করবো? তিনি বললেন: না, বরং তুমি প্রতি দিনের রোযার বিনিময়ে একজন করে মিসকীনকে অর্ধ দ্বা’ ফিদিয়া আদায় করা। (মুশকিলুল আছার-ত্বাহাবী)
আবু দাউদের বর্ণনা সূত্রে হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: যখন কোন ব্যক্তি রমযান মাসে অসুস্থ হয় অতঃপর রোযা আদায় না করে যদি মারা যায়, তাহলে তার পক্ষ হতে খানা খাওয়াতে হবে। তার কাযা আদায় করতে হবে না। (হা: নং ২৪০১)

- Advertisement -

৪. মৃত ব্যক্তির কোন হজ্জ করা বাকি থাকলে তার পক্ষ থেকে হজ্জ করা

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, জুহাইনা গোত্রের এক মহিলা নবী (দ্বঃ)-এর নিকট এসে বলল, আমার মা হজ্জ আদায় করার মানত করেছিলেন। কিন্তু তিনি হজ্জ আদায় না করে মৃত্যু বরণ করেছেন। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করতে পারি? নবী (ছঃ) বললেন:
حجى عَنْهَا أَرَنْتَ لَوْ كَانَ عَلَى أُمِّكَ دَيْنُ أَكُنْت قَاضِيَة أَقْضُو اللَّهَ فَإِنَّ اللَّهَ أَحَقُّ بِالْوَفَاء.
তার পক্ষ থেকে তুমি হজ্জ আদায় কর। তুমি এ ব্যাপারে কি মনে কর, যদি তোমার মা’র উপর ঋণ থাকতো তাহলে কি তা আদায় করতে না? (নিশ্চয় তুমি তা আদায় করতে)। সুতরাং (ফরয বা মানতের হজ্জও) আল্লাহর হক্ক, তা আদায় কর। কেননা, আল্লাহর হকই সবচেয়ে বেশি আদায়যোগ্য। (বুখারী হা: নং ১৭১৯)

৫. মৃত ব্যক্তি ঋণী হয়ে থাকলে তার পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ করা

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (জ্বঃ) বলেছেন:
عنه. نَفْسُ الْمُؤْمِن مُعَلَّقَةٌ بِدَيْنِيهِ حَتَّى حتى يقضى سی
ঋণী মুমেন ব্যক্তির রূহ তার পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত তার ঋণের সাথে বন্ধক থাকে। (তিরমিজী- হা: নং ১০১৬)

৬. মৃত ব্যক্তির কোন (শরী’য়ত সম্মত) মান্নত অপূর্ণ থাকলে তার পক্ষ থেকে তা পূর্ণ করা

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, সা’দ ইবনে ইবাদাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর কাছে ফতোয়া চেয়ে বললেন, আমার মা মান্নত রেখে মারা গেছেন (এখন কি করা যায়) রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বললেন: أَقضه عَنْهَا তুমি তার পক্ষ হতে তা আদায় কর। (বুখারী হা: নং ২৫৫৮)

৭. মৃত ব্যক্তির কবর কিংবা কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাতাযাতের সময় তাদের জন্য দু’আ করা

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) কবস্থানের দিকে যাওয়া হলে বলতেন:
السَّلَامُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤْمِنِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لاحِقُونَ
তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক হে মৃতপুরীর মুমিনগণ। আল্লাহর হুকুম হলে আমরাও তোমাদের সাথে মিলিত হবো। (আবু দাউদ, হা: নং ৩২৩৭)

৮. মৃত ব্যক্তির কবর যিয়ারত করা

 

আগের পাতা: ০৭ | পরবর্তী পাতা: ০৯

- Advertisement -

Comments
Loading...